ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ মাছের সম্পূরক খাদ্য

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - কৃষিশিক্ষা - কৃষি প্রযুক্তি | NCTB BOOK

মাছের সম্পূরক খাদ্যের পরিচিতি ও প্রয়োজনীয়তা দেহের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য মাছ পুকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা) ) জু-প্লাংকটন (প্রাণিকণা) খুদিপানা, ছোট জলজ পতঙ্গ, পুকুরের তলদেশের কীট, লার্ভা, কেঁচো, ছোট ছোট শামুক, ঝিনুক, মৃত জৈব পদার্থ ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে । কিন্তু মাছ চাষের ক্ষেত্রে অধিক উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরে অধিক ঘনত্বে পোনা ছাড়া হয় । এ অবস্থায় শুধু প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক উৎপাদন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় । এমনকি সার প্রয়োগ করে প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধি করলেও তা যথেষ্ট হয় না । এজন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে বাহির থেকে অতিরিক্ত খাদ্য দিতে হয় । একে সম্পূরক খাদ্য বলে । যেমন-চালের কুঁড়া, সরিষার খৈল, ফিশ মিল ইত্যাদি । গ্রাসকার্প ও সরপুঁটি মাছ উদ্ভিদভোজী বলে এদের জন্য খুদিপানা, কুটিপানা, শাকসবজির নরম পাতা, ঘাস কেটে সম্পূরক খাবার হিসাবে পুকুরে দেওয়া যায়। মাছকে সরবরাহকৃত সম্পূরক খাদ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন-আমিষ, স্নেহ বা তেল, শর্করা, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের মাত্রা যেন চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন । যে সম্পূরক খাবার এ সকল পুষ্টি উপাদান যথাযথ মাত্রায় রেখে তৈরি করা হয় তাকে সুষম সম্পূরক খাদ্য বলে ।

মাছের সম্পূরক খাদ্যের উৎস

মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান ব্যবহার করা হয় । উৎসের উপর ভিত্তি করে এসব উপাদানকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ক) উদ্ভিদজাত খ) প্রাণিজাত । নিচে এদের কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো-

ক) উদ্ভিদজাত: উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদানের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে- চালের কুঁড়া, গম ও ডালের মিহিভুসি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, আটা, চিটাগুড়, খুদিপানা, রান্না ঘরের উচ্ছিষ্ট, বিভিন্ন নরম পাতা যেমন- মিষ্টিকুমড়া, কলাপাতা, বাঁধাকপি ইত্যাদি ।

খ) প্রাণিজাত: প্রাণিজাত কয়েকটি খাদ্য উপাদান হচ্ছে শুটকি মাছের গুঁড়া বা ফিশমিল, রেশম কীট মিল, চিংড়ির গুঁড়া (স্রিম্প মিল), কাঁকড়ার গুঁড়া, হাড়ের চূর্ণ (বোন মিল), শামুকের মাংস, গবাদিপশুর রক্ত (ব্লাড মিল) ইত্যাদি ।

সম্পূরক খাদ্যের উপকারিতা

১। মাছকে নিয়মিত সম্পূরক খাবার সরবরাহ করলে অধিক ঘনত্বে পোনা ও বড় মাছ চাষ করা যায় ।

২। অল্প সময়ে বড় আকারের সুস্থসবল পোনা উৎপাদন করা যায় ।

৩। পোনার বাঁচার হার বেড়ে যায় ।

৪ । মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।

৫ । মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে ।

৬। মাছ পুষ্টির অভাবজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকে ।

৭। সর্বোপরি কম সময়ে জলাশয় থেকে অধিক মাছ ও আর্থিক মুনাফা পাওয়া সম্ভব হয় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা সহজলভ্য কয়েকটি খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করবে এবং উপাদানের নাম খাতায় লিখবে ।

মাছের পুষ্টি চাহিদা ও সম্পূরক খাদ্য তালিকা

মাছের প্রজাতি, বয়স ও আকারের উপর ভিত্তি করে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা বিভিন্ন হয় । প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন মাছের রেণু পোনার জন্য দেহের ওজনের ১০-২০%, আঙ্গুলে পোনার জন্য ৫-১০% এবং বড় মাছের জন্য ৩-৫% হারে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয় । সুস্থ-সবল মাছ ও এর দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য মাছের খাবারে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকা আবশ্যক । এসব উপাদানের মধ্যে আমিষ বা প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। এটি খাবারে বেশি মাত্রায় প্রয়োজন। এজন্য মাছের পুষ্টি চাহিদা বলতে প্রধানত আমিষের চাহিদাকে বোঝায় । মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান যেমন-শর্করা, তেল ও খনিজ লবণ কম-বেশি বিদ্যমান থাকে । এসব খাদ্যে আমিষের চাহিদা পূরণ হলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলোর খুব একটা অভাব হয় না । খাদ্যে আমিষের এই চাহিদা প্রজাতি ও জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তর ভেদে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের জন্য ২০-৩০%, চিংড়ির জন্য ৩০-৪৫% ও ক্যাটফিশ (আঁশ বিহীন লম্বা শুঁড়যুক্ত মাছ) বা মাগুর জাতীয় মাছের জন্য ৩৫-৪৫% থাকে । একটি পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে যখন মাছ উৎপাদন করা হয় তখন ঐ খাদ্য কী পরিমাণ মাছ দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে (মাছ খাচ্ছে) এবং তা থেকে কী পরিমাণ মাছ উৎপাদন হচ্ছে তা খাদ্য রূপান্তর হার বা FCR (Food Conversion Ratio) নির্ণয়ের মাধ্যমে হিসাব করা যায়। এভাবে একাধিক খাদ্যের FCR FCR নির্ণয় করে তুলনা করলে কোন খাদ্য অধিক ভালো তা বোঝা যায় । সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে খাদ্য রূপান্তর হার বা FCR হচ্ছে খাদ্য প্রয়োগ ও খাদ্য গ্রহণের ফলে জীবের দৈহিক বৃদ্ধির অনুপাত । অর্থাৎ ১ কেজি মাছ পেতে যত কেজি খাবার খাওয়াতে হয়, তাই খাদ্য রূপান্তর হার ।

FCR= মাছকে প্রদানকৃত খাদ্য/ দৈহিক বৃদ্ধি

দৈহিক বৃদ্ধি = আহরণকালীন মোট ওজন - মজুদকালীন মোট ওজন

ধরা যাক, একটি পুকুরে কিছু মাছের পোনা ছাড়া হলো যার মোট ওজন ১ কেজি । নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করে ৬ মাস পর আহরণের সময় মোট ১৫ কেজি মাছ পাওয়া গেল । এ ৬ মাসে মোট ২১ কেজি খাদ্য প্রয়োগ করা হলো ।

সুতরাং, FCR = ২১ /১৫ - ১ = ১.৫

FCR-এর মান সবসময় ১ এর চেয়ে বড় হয় । যে খাদ্যের FCR এর মান যত কম সে খাদ্যের গুণগত মান তত ভালো অর্থাৎ, সে খাদ্য ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন করা যায় ।
কার্প বা রুই জাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে নিম্নের উপাদানগুলোর মিশ্রণে সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা যায়-

উপকরণের নাম শতকরা হার (%)
ফিসমিল ১০-২১
সরিষার খৈল ৪৫-৫৩
চালের কুঁড়া ২৮-৩০
ভিটামিন ও খনিজ লবণ ০.৫-১.০
চিটাগুড় ও আটা
মোট ১০০

মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুত প্রণালি
প্রথমে ভালো মান সম্পন্ন নির্ধারিত খাদ্য উপাদানসমূহ সংগ্রহ করতে হবে । উপাদানসমূহ প্রয়োজনে আটা পেষা মেশিনে বা ঢেঁকিতে ভালো করে চূর্ণ বা গুঁড়া করে নিতে হবে এবং চালনি দিয়ে চেলে নিতে হবে । সূত্র অনুযায়ী খাদ্য উপাদানসমূহ একটি একটি করে মেপে নিয়ে মিক্সার মেশিনে বা একটি বড় পাত্রে ভালোভাবে মেশাতে হবে । মেশানো উপাদানগুলোতে পানি দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে মণ্ড তৈরি করতে হবে । এখন মণ্ড ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে ভেজা বা আর্দ্র খাদ্য হিসাবে মাছকে দিতে হবে । মাছকে সরবরাহকৃত খাবার পানিতে বেশি স্থিতিশীল রাখার জন্য বাইন্ডার হিসাবে আটা বা ময়দা বা চিটাগুড় ব্যবহার করা যায় । ভেজা বা আর্দ্র খাবার প্রতিদিন প্রয়োগের পূর্বে পরিমাণমতো তৈরি করতে হবে । আবার এই মণ্ড দিয়ে সহজ পদ্ধতিতে স্বল্প মূল্যে দেশীয় পিলেট মেশিনের সাহায্যে পিলেট বা দানাদার খাবার তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পিলেট বা দানাদার খাবার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে এবং পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য বায়ুরোধী প্লাষ্টিক ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে। খৈলে কিছু বিষাক্ত উপাদান থাকে, যা মাছের জন্য ক্ষতিকর । তাই খৈল একদিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করতে হয় । খৈল ভেজানো পানি মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না। সুষম খাদ্য তৈরির জন্য নির্বাচিত খাদ্য উপাদানের সাথে ০.৫-১% ভিটামিন ও খনিজ লবণের মিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে। ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ কিনতে পাওয়া যায় ।

মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি

১। মাছ দিনের বেলায় খাবার গ্রহণ করে । এজন্য চাষের পুকুরে দিনের প্রয়োজনীয় খাবার সমান দু'ভাগে ভাগ করে এক ভাগ সকালে এবং অন্য ভাগ বিকালে দিতে হবে। অন্যদিকে চিংড়ি নৈশভোজী বলে এদেরকে সন্ধ্যায় বা রাতে খাবার দিতে হয় ।

২। প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন মাছের রেণু পোনার জন্য দেহের ওজনের ১০-২০%, আঙ্গুলে পোনার জন্য ৫- ১০% এবং বড় মাছের জন্য ৩-৫% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। পোনা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ১ বার এবং মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে ১৫ দিন বা মাসে ১ বার জাল টেনে কয়েকটি মাছের গড় ওজন নিয়ে পুকুরে সর্বমোট যতটি মাছ ছাড়া হয়েছিল তা দিয়ে গুণ করলে পুকুরে মোট মাছের ওজন পাওয়া যাবে । এভাবে দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে খাবারের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে ।

৩। পুকুরে গ্রাসকার্প ও সরপুঁটি চাষ করা হলে এদেরকে খুদিপানা, কুটিপানা, সবুজ ঘাস, হেলেঞ্চা, কচুরিপানার নরম অংশ ও বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতা যেমন-বাঁধাকপি, পুঁইশাক, কলাপাতা কেটে পুকুরে সরবরাহ করতে হবে । এ উদ্দেশ্যে বাঁশের টুকরা বা গাছের ডালদিয়ে বর্গাকারের একটি ফ্রেম তৈরি করতে হবে । ফ্রেমটি একটি খুঁটির সাহায্যে পুকুরের পানিতে স্থাপন করতে হবে যেন এটি সবসময় একই স্থানে থাকে । এই ফিডিং ফ্রেম বা রিং-এ উপরোক্ত খাদ্য দিতে হবে । মাঝে মাঝে এটি পরিষ্কার করতে হবে।

৪ । শুকনো খাবার পানির উপরে ছিটিয়ে এবং আর্দ্র বা ভেজা খাবার পানির ৩০-৬০ সেমি নিচে স্থাপিত খাদ্যদানি, ট্রে বা মাচায় প্রয়োগ করতে হবে । এতে খাদ্যের অপচয় কম হবে ।

৫। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পুকুরের চারপাশে ৩-৪ টি নির্দিষ্ট স্থানে খাবার দিতে হবে । এতে করে খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে ।

৬। শীতকালে মাছের বৃদ্ধি কম হয় বলে খাদ্য প্রয়োগের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বা তিনভাগের একভাগ কমিয়ে আনতে হয় ।

৭। পুকুর অত্যধিক সবুজ হয়ে গেলে খাবার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে ।

৮। খাদ্য প্রয়োগের যথেষ্ট সময় পর খাবার থেকে গেলে বুঝতে হবে খাদ্যের পরিমাণ বেশি হয়েছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা নিকটস্থ যে কোনো মৎস্য খামারে গিয়ে মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি দেখে প্রতিবেদন লিখে জমা দিবে।

নতুন শব্দ : ব্লাড মিল, বোন মিল, সিম্প মিল, ফিডিং ফ্রেম/রিং, খাদ্যদানি, খাদ্যরূপান্তর হার (FCR)

পশুপাখির সম্পূরক খাদ্য
পশুপাখির উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এদেরকে প্রচলিত খাবারের সাথে বিশেষ খাদ্য সরবরাহ করা হয় । এতে পশুপাখির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং পরিপুষ্টি লাভ করে। পশুপাখির মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় । তাই পশুপাখি পালনে সম্পূরক খাদ্যের অধিক গুরুত্ব রয়েছে ।

বিভিন্ন সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি-

ক) ইউরিয়া মোলাসেস খড় : ইউরিয়ার সাহায্যে খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ-

উপকরণ

খড় : ২০ কেজি,

ইউরিয়া : ১ কেজি

পানি : ২০ লিটার,

একটি মাঝারি আকারের পাত্র, বস্তা ও মোটা পলিথিন ।

তৈরির পদ্ধতি

১। প্রথমে একটি বালতিতে ১ কেজি ইউরিয়া ২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে নিতে হবে

২। ডোলের চারদিকে গোবর ও কাদা মিশিয়ে লেপে শুকিয়ে নিতে হবে ।

৩। এবার ডোলের মধ্যে অল্প অল্প খড় দিয়ে ইউরিয়া মেশানো পানি ছিটিয়ে দিতে হবে ।

৪। সমস্ত খড় সম্পূর্ণ পানি দ্বারা মিশিয়ে ডোলের মুখ বস্তা ও মোটা পলিথিন দিয়ে বেঁধে দিতে হবে ।

৫। দশ দিন পর খড় বের করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে ।

প্রয়োগ পদ্ধতি

১। একটি গরুকে দৈনিক ২-৩ কেজি ইউরিয়া মেশানো খড় খাওয়াতে হবে ।

২। খড়ের সাথে দৈনিক ৩০০ গ্রাম ঝোলাগুড় মিশিয়ে দিতে হবে।

খ) ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক : দানাদার খাদ্যের সাহায্যে ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক তৈরিকরণ-

উপকরণ

গমের ভুসি : ৩ কেজি

ঝোলাগুড় : ৬ কেজি

ইউরিয়া: ৯০ গ্রাম

লবণ : ৩৫ গ্রাম

খাবার চুন : ৫০০ গ্রাম

ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স : ৫০ গ্রাম এবং

কাঠের ছাঁচ (১ কেজি ব্লক তৈরির জন্য)

তৈরির পদ্ধতি

চিত্র : ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক তৈরির উপকরণ

১। প্রথমে একটি লোহার কড়াইতে সামান্য ভিটামিন মিনারেল মিশ্রণ ঝোলাগুড়সহ জ্বাল দিয়ে সামান্য ঘন করতে হবে।

২। কড়াই চুলা থেকে নামিয়ে এর মধ্যে ইউরিয়া, চুন, লবণ, গমের ভুসি যোগ করে ভালোভাবে মেশাতে হবে ।

৩। এরপর ছাঁচের মধ্যে কিছু ভুসি ছিটিয়ে মিশ্রিত দ্রব্যগুলো ভরে ব্লক তৈরি করতে হবে ।

৪ । ব্লকগুলো শুকনো আলো বাতাসযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে ।

প্রয়োগ পদ্ধতি

১। একটি গরুকে দৈনিক ৩০০ গ্রাম ব্লক জিহ্বা দিয়ে চেটে খেতে দিতে হবে ।

২। প্রথমে ব্লক জিহ্বা দিয়ে চেটে খেতে না চাইলে ব্লকের উপর কিছু ভুসি ও লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে।

গ) গবাদিপশুকে অ্যালজি বা শেওলা খাওয়ানো

অ্যালজি বা শেওলা এক ধরনের উদ্ভিদ যা আকারে এককোষী থেকে বহুকোষী হতে পারে। তবে এখানে দুটি বিশেষ প্রজাতির এক কোষী অ্যালজির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এদের মধ্যে প্রধান হলো ক্লোরেলা। এরা সূর্যালোক, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জৈব নাইট্রোজেন আহরণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকে। এরা বাংলাদেশের মতো উষ্ণ জলবায়ুতে দ্রুত বর্ধনশীল ।

অ্যালজির পুষ্টিমান

অ্যালজি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পুষ্টিকর খাদ্য যা বিভিন্ন ধরনের আমিষ জাতীয় খাদ্য যেমন- খৈল, শুঁটকি মাছের গুঁড়া ইত্যাদির বিকল্প হিসাবে ব্যবহার হতে পারে । শুষ্ক অ্যালজিতে শতকরা ৫০-৭০ ভাগ আমিষ, ২০-২২ ভাগ চর্বি এবং ৮-২৬ ভাগ শর্করা থাকে। এছাড়াও অ্যালজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং বিভিন্ন ধরনের বি ভিটামিন থাকে। অ্যালজি পানি ব্যবহার করে কম খরচে গরুর মাংস এবং দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ।

অ্যালজি চাষের প্রয়োজনীয় উপকরণ

অ্যালজির বীজ, কৃত্রিম অগভীর পুকুর বা জলাধার, পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি, মাসকলাই বা অন্যান্য ডালের ভুসি ও ইউরিয়া ।

অ্যালজির উৎপাদন পদ্ধতি

  • প্রথমে সমতল ও ছায়াযুক্ত জায়গায় একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরি করতে হবে। জলাধারটি লম্বায় ৩ মিটার, চওড়ায় ১.২ মিটার এবং গভীরতায় ০.১৫ মিটার হতে পারে। এর পাড় ইট বা মাটির তৈরি হতে পারে । এবার ৩.৩৫ মিটার, ১.৫২ মিটার চওড়া একটি স্বচ্ছ পলিথিন বিছিয়ে কৃত্রিম জলাধারটির তলা ও পাড় ঢেকে দিতে হবে। তবে জলাধারটির আয়তন প্রয়োজন অনুসারে ছোট বা বড় হতে পারে । তাছাড়া মাটির বা সিমেন্টের চাড়িতে অ্যালজি চাষ করা যায় ।
  •  এরপর ১০০ গ্রাম মাসকলাই বা অন্য ডালের ভুসিকে ১ লিটার পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে কাপড় দিয়ে ছেঁকে পানিটুকু সংগ্রহ করতে হবে । এভাবে একই ভুসিকে অন্তত তিনবার ব্যবহার করে পরবর্তীতে গরুকে খাওয়ানো যায় ।
  • এবার কৃত্রিম পুকুরে ২০০ লিটার পরিমাণ কলের পরিষ্কার পানি, ১৫-২০ লিটার পরিমাণ অ্যালজির বীজ এবং মাসকলাই ভুসি ভেজানো পানি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর ২-৩ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া নিয়ে উক্ত পুকুরের পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে ।
  •  এরপর প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকালে কমপক্ষে তিনবার উক্ত অ্যালজির পানিকে নেড়ে দিতে হবে । পানির পরিমাণ কমে গেলে নতুন করে পরিমাণ মতো পরিষ্কার পানি যোগ করতে হবে। প্রতি ৩/৪ দিন পর পর পুকুরে ১-২ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া ছিটালে ফলন ভালো হয় ।
  •  এভাবে উৎপাদনের ১২-১৫ দিনের মধ্যে অ্যালজির পানি গরুকে খাওয়ানোর উপযুক্ত হয়। এসময় অ্যালজির পানির রং গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। অ্যালজির পানিকে পুকুর থেকে সংগ্রহ করে সরাসরি গরুকে খাওয়ানো যায় । প্রতি ১০ বর্গমিটার পুকুর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লিটার অ্যালজির পানি উৎপাদন করা সম্ভব ।
  • একটি পুকুরের অ্যালজির পানি খাওয়ানোর পর উক্ত পুকুরে আগের নিয়ম অনুযায়ী পরিমাণ মতো পানি, সার এবং মাসকলাই ভুসি ভেজানো পানি দিয়ে নতুন করে অ্যালজি চাষ শুরু করা যায়, এ সময় নতুন করে অ্যালজি বীজ দিতে হয় না ।
  •  যখন অ্যালজি পুকুরে পানির রং স্বাভাবিক গাঢ় সবুজ রং থেকে বাদামি রং হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে যে উক্ত কালচারটি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে । এ ক্ষেত্রে নতুন করে কালচার শুরু করতে হবে ।

খাওয়ানো পদ্ধতি

১। সব বয়সের গরুকে অর্থাৎ বাছুর, বাড়ন্ত গরু, দুধের বা গর্ভবতী গাভী, হালের বলদ সবাইকে সাধারণ পানির পরিবর্তে অ্যালজির পানি খাওয়ানো যায় ।

২। এ ক্ষেত্রে গরুকে আলাদা করে পানি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই ।

৩। অ্যালজি পানি দানাদার খাদ্য অথবা খড়ের সাথে মিশিয়েও খাওয়ানো যায় ।

৪। অ্যালজির পানিকে গরম করে খাওয়ানো উচিত নয়, এতে অ্যালজির খাদ্যমান নষ্ট হতে পারে ।

৫। খামারের ৫টি গরুর জন্য ৫টি কৃত্রিম পুকুরে অ্যালজি চাষ করতে হয় যাতে একটির অ্যালজির পানি শেষ হলে পরবর্তীটি খাওয়ানোর উপযুক্ত হয় ।

ঘ) বাজারে তৈরি সম্পূরক খাদ্য : পশুপাখির উৎপাদন চলমান রাখার জন্য এদেরকে বাজারে তৈরি বিভিন্ন সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে ।

 

১। আমিষ সম্পূরক খাদ্য যেমন, প্রোটিন কনসেনট্রেট

২।খনিজ সম্পূরক - ভিটামিন ও খনিজ প্রিমিক্স

৩। খাদ্যপ্রাণ সম্পূরক - ভিটামিন ও খনিজ প্রিমিক্স ।

ঙ) বাছুরের সম্পূরক খাদ্য তালিকা-

মিল্ক রিপ্লেসার (Milk Replacer) : বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের তরল পশুখাদ্য যাতে দুধের উপাদান থাকে এবং বাছুরের জন্য দুধের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। এতে ২০% আমিষ ও ১০% এর অধিক চর্বি থাকে । এর উপাদানসমূহকে গরম স্কিম মিল্কে বা পানিতে মিশ্রিত করা হয় ।

প্রয়োগ পদ্ধতি : বাছুরের বয়স অনুসারে দৈনিক ০.৫ থেকে ৩ লিটার পর্যন্ত খাওয়ানো যায় ।

মিল্ক রিপ্লেসার (Milk Replacer) তৈরির একটি নমুনা নিম্নে দেওয়া হলো-

ক্রমিক উপকরণ
 
রেশন-১ (%) রেশন -২ (%)
স্কিম মিল্ক ৬৫ -
স্কিম মিল্ক পাউডার -
পানি - ৬০
উদ্ভিজ্জ তেল ২০ ২০
ছানার দুধ ১০
ভিটামিন ও খনিজ প্রিমিক্স ০৫ ০৫
  মোট ১০০ ১০০

কাফ স্টার্টার (Calf Starter) : বাছুরের খাবার উপযোগী বিশেষ দানাদার খাদ্য মিশ্রণ যাতে ২০% এর অধিক পরিপাচ্য আমিষ ও ১০% এর কম আঁশযুক্ত খাদ্য থাকে । কাফ স্টার্টারের একটি নমুনা নিম্নে দেওয়া হলো-

ক্রমিক উপকরণ পরিমাণ (%)
তুলাবীজ ৩৮
ভুট্টা ৩০
যব ১০
ছানার গুঁড়া ১০
গমের ভুসি ১০
হাড়ের গুঁড়া
খাদ্য লবণ
  মোট ১০০
কাজ : শিক্ষার্থীরা গবাদিপশুর বিভিন্ন খাদ্য উপকরণের তালিকা তৈরি করবে ।

প্রয়োগ পদ্ধতি : বাছুরের বয়স অনুসারে দৈনিক ০.৫ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত খাওয়ানো যায় ।

Content added || updated By
Promotion